আমাদের জীবনে গুনাহের ৬ টি কুপ্রভাব


একজন মুসলিম হিসেবে আমরা জানি গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা আমাদের জন্য কতটা জরুরি। গুনাহের কারণে আমাদেরকে দুনিয়া এবং আখেরাতে, উভয় জগতে আজাবের সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু,অপরদিকে গুনাহ থেকে পুরোপুরি বেঁচে থাকা একজন মানুষের পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। মানুষ এতটাই দুর্বল যে, সে খুব সহজে গুনাহে লিপ্ত হয়ে যায়।






প্রত্যেক বনি আদম গুনাহগার এবং তাদের মধ্যে তারাই শ্রেষ্ঠ যারা গুনাহ করে এবং তওবা করে ফেরত আসে।

সুনানে ইবনে মাজাহ, ৪৩৯২




একেবারেই কোন গুনাহ হবে না, এরকম জীবন আমাদের পক্ষে সম্ভব না হলেও, গুনাহের কি কি প্রভাব আমাদের জীবনে আসতে পারে, সেটা জানলে আমাদের জন্য অবশ্যই কল্যাণকর হবে। আমরা খুব সহজেই গুনাহ থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখতে সচেষ্ট হব।





নিচে গুনাহের ৬ টি প্রভাব আলোচনা করা হলো, যা আমাদেরকে পরবর্তীতে গুনাহ থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করবে।





এক গুনাহ আরেক গুনাহকে আকর্ষণ করে





আমরা যখন কোন গুনাহ করি তখন একটি গুনাহ হিসেবে আমাদের আমলনামায় লেখা হয়। সেটা তওবা করার আগ পর্যন্ত আমলনামায় লেখা থাকে। এভাবে আমরা যত বেশি গুনাহ করি, ততো বেশি আমাদের আমলনামায় গুনাহ লেখা হয় এবং এভাবে আমাদের আমলনামায় গুনাহের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে গুনাহের সংখ্যা বেড়ে গিয়ে নেক আমলের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যায়। ফলে গুনাহের পাল্লা ভারী হয়ে যায়।
এভাবে গুনাহ করতে করতে এক পর্যায়ে গুনাহের প্রতি আমাদের এক ধরনের অভ্যস্থতা তৈরি হয়। ফলে গুনাহকে আর গুনাহ মনে হয়না।
আর যখনই কেউ কোন গুনাহতে অভ্যস্ত হয়ে যায় তখন তার পক্ষে সেই গুনাহ থেকে ফেরত আসা ততবেশি কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
যেমন আপনি নিয়মিত টিভিতে সংবাদ দেখেন। আপনি জানেন যে সংবাদে যে সমস্ত সংবাদ পাঠিকা সংবাদ পড়ে তারা বেগানা নারী। তাদের দিকে তাকানো আপনার জন্য হারাম। কিন্তু প্রথমে একটু আধটু দেখতে দেখতে একপর্যায়ে এমন হয়ে যায় যে এদের দিকে তাকানো কে আর গুনাহ মনে হয়না। অথচ প্রতিনিয়তই এদের দিকে তাকানোর ফলে যিনার গুনাহ আমলনামায় লেখা হচ্ছে। এভাবে অনেক দিন চলার কারণে যখন অভ্যস্থতা হয়ে যায়, তখন এই গুনাহ থেকে ফেরত আসা টাও অনেক বেশি কঠিন হয়ে যায়।





এরপর শুরু হয় দ্বিতীয় ধাপ।টিভিতে বেগানা নারীকে দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার ফলে এখন রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতে বেগানা নারীর প্রতি দৃষ্টিপাত করা থেকে নিজেকে রক্ষা করাও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এবং এভাবে নিজের নফসের সাথে যুদ্ধ করতে করতে এক পর্যায়ে হার মানতে বাধ্য হই আমরা। অতপর টিভি থেকে এখন বাস্তব জীবনে বেগানা নারীর প্রতি আমাদের বৃষ্টিপাত হতে থাকে। কিন্তু এর কোনো প্রভাব আমাদের অন্তরে সৃষ্টি হয় না। এভাবে প্রতিনিয়ত দৃষ্টিপাতের ফলে আমাদের অন্তর কাল হতে হতে আধারের চেয়েও বেশি কালো হয়ে যায়। তখন আর আল্লাহ এবং রাসুলের কথা আমাদের অন্তরে প্রবেশ করতে চায় না। এভাবে আমরা ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাই।





গুনাহের ফলে অন্তর পাথরের চেয়েও শক্ত হয়ে যায়





উপরের
আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, আমাদের অন্তর ক্রমান্বয়ে গুনাহের ফলে,
কাল থেকে কাল হয়ে পাথরের চেয়েও বেশি কঠিন হয়ে যায়।
যেমন কোন চোর
যখন চুরি করতে শেখে তখন সে ছোটখাট জিনিস চুরি দিয়ে তার পেশাটা শুরু করে।
প্রথমে সে খুবই নগণ্য জিনিস চুরি করে। এরপর আস্তে আস্তে তার লোভ বাড়তে
থাকে। সে বড় থেকে বড় জিনিস চুরি করা শুরু করে। এবং একপর্যায়ে সে ডাকাতি
করা শুরু করে। এবং এভাবে সে মানুষ খুন করার মত নিকৃষ্ট কাজ করতে দ্বিধাবোধ
করে না।





এখানে সে ছিল নগণ্য এক চোর। কিন্তু ক্রমান্বয়ে কালান্তরে তার অন্তর শক্ত হতে হতে এত বেশি শক্ত হয়ে গিয়েছে যে পরবর্তীতে খুনের মতো জঘন্য কাজ ও তার কাছে খুবই স্বাভাবিক হয়ে গেছে।





গুনাহ মানুষকে আল্লাহ থেকে দূরে সরে নিয়ে যায়





গুনাহ মানুষকে আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। আর যখন কেউ আল্লাহ থেকে দূরে সরে যায় অর্থাৎ আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়, তার ধ্বংস অনিবার্য। গুনাহ করতে করতে যখন অন্তর অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়, তখন সেই অন্তর আল্লাহ তায়ালার রহমত থেকেও দূরে চলে যায়। তার সামনে কোরআন পাঠ করলে তার প্রভাব তার অন্তরে পরেনা। কোন হাদিস বা নসীহত তার কান দিয়ে ঢোকে না। আস্তে আস্তে সে ফরজ ইবাদত থেকে ফারেগ হওয়া শুরু করে।





" যখন একজন মুসলিম গুনাহ করে, তার অন্তরে ছোট্ট একটা কালো দাগ পড়ে যায়। এরপর যদি সে তওবা করে এবং সেই গুনাহ ছেড়ে দেয় এবং আল্লাহর কাছে মাফ চায়। তাহলে সেই কালো দাগটা তার অন্তর থেকে দূর করে দেয়া হয়। কিন্তু তা না করে যদি সে সেই গুনাহ জারী রাখে, তাহলে তার অন্তরে আরো কালো দাগ পড়তে থাকে। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ তা'আলা তাঁর কিতাবে বলেছেনঃ কখনও না, বরং তারা যা করে, তাই তাদের হৃদয় মরিচা ধরিয়ে দিয়েছে। (কোরআন ৮৩ঃ১৪)

সুনানে ইবনে মাজাহ, ৪৩৮৫।




অন্যরাও গুনাহতে অনুপ্রাণিত হয়





অনেক সময়ে অনেকেই পরিবেশের কারণে অথবা সোহবতের কারণে গুনাহে জড়িয়ে পড়ে। হয়তো সে ব্যক্তি একা থাকলে এই গুনাহটি করত না। কিন্তু আরেক জনকে গুনাহ করতে দেখে সেও অনুপ্রাণিত হয়। এর প্রকৃষ্ট উদাহারণ হলো ধূমপান। সাধারণত দেখা যায়, যে বাসায় ধূমপান হয় সে বাসার ছেলে সন্তানরাও বড় হয়ে ধুমপায়ী হয়ে ওঠে। তাছাড়া বন্ধু-বান্ধবদের যদি কেউ ধূমপায়ী হয়ে থাকে, তাহলে তার প্রভাবে ও অন্যরা ধূমপান শুরু করে দেয়।





তাই অন্য কারো
সামনে যদি আমরা কোন গুনাহ করি। হতে পারে আমার অজান্তেই সেই গুনাহ তাকে
প্রভাবিত করে ফেলতে পারে। আর ফলশ্রুতিতে তার গুনাহের ভাগীদার আমিও হয়ে
যেতে পারি।





রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,





যে কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করে এবং তার ডাকে যদি কেউ সাড়া দেয় তাহলে তাকে ওই ব্যক্তির আমলের সওয়াব প্রদান করা হয় অথচ আমলকারী ব্যক্তির আমলের সওয়াব কোন অংশেই কম করা হয় না। এবং যে ব্যক্তি কোন গুনাহের দিকে কাউকে দাওয়াত দেয় এবং সে কারণে অন্য কেউ তার ডাকে সাড়া দিয়ে সে গুনাহ করে, তবে তাকেও সেই গুনাহের সমপরিমাণ গুনাহ তার আমলনামায় লিখে দেওয়া হয় অথচ গুনাহকারীর গুনাহ কোন অংশে কম করা হয় না।

তিরমিজি , ২৬৭৪




ঈমানহারা হয়ে যাওয়া





গুনাহ সাধারণত গুনাহ হিসেবে গুনাহগারের আমল নামায় লিখা হয়। এটা তার অন্তরে এবং আমলে প্রভাব ফেলে। কিন্তু এভাবে গুনাহ করতে করতে বান্দা এমন গুনাহে লিপ্ত হয়ে যায় যা তাকে ইসলাম থেকে বের করে নিয়ে যায়। অথচ সে সেটা বুঝতেই পারেনা।
উদাহরণ হিসেবে গণকের কাছে যাওয়ার কথা বলা যায়। আমরা অনেকেই জানি যে গণকের কাছে যাওয়া শিরক। কিন্তু তার পরেও অনেকেই জেনেশুনে গণকের কাছে যায়। এভাবে যেতে থাকে কিন্তু পরবর্তীতে আর তওবা নসিব হয় না। ফলে এই শির্ক অবস্থাতেই সে মারা যায় এবং ঈমান হারা হয়ে আল্লাহর কাছে পৌঁছে।





রিজিক সংকুচিত হয়ে যাওয়া





গুনাহের কারণে বান্দা রিজিক সংকুচিত হয়, কেড়ে নেওয়া হয় অথবা দেরিতে দেয়া হয়। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে এক প্রকারের আজাব।
রাসূল সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম বলেছেন,





কেবল সৎ কর্মই আয়ু বৃদ্ধি করে এবং দু’আ ব্যতীত অন্য কিছুতে তাকদীর রদ হয় না। মানুষের অসৎ কর্মই তাকে রিয্‌ক বঞ্চিত করে।

সুনানে ইবনে মাযাহ, ৯০




আমরা হয়তো আমাদের গুনাহের প্রভাব অনুভব করি না বা বুঝতে পারিনা। কারণ গুনাহের প্রভাব বোঝার জন্য যে সূক্ষ্ম জ্ঞান বা বিচক্ষণতা আমাদের দরকার তা আমাদের থাকে না। এবং হাশরের ময়দানে হিসাব নিকাশ এর আগেও আমাদের পক্ষে তা বোঝা সম্ভব নয়। তাই আসুন জীবন থাকতে থাকতেই মহান আল্লাহর কাছে ক্রমান্বয়ে ক্রমাগত তওবা-ইস্তেগফার করি এবং নিজের গুনাহের জন্য মাফ চাই। মালাকুল মউত এসে গেলে তওবা করার সুযোগ থাকবে না।





গুনাহ মাফ কিভাবে হবে? পড়ুনঃ




No comments:

Powered by Blogger.