ইসলামে জুমুয়ার দিনের মর্যাদা

3:27:00 PM



একজন মুসলিমের জীবনে জুমুয়ার দিন অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। ইসলামে জুমুয়ার দিনকে সপ্তাহের অন্য ৬ দিনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে। হযরত আবু হুরায়রাহ্‌ এবং হুযায়ফা (রাঃ) এর রেওয়াতে মুসলিম শরীফে এসেছে যে, উম্মতে মুহাম্মদীর পূর্বে যারা উম্মত ছিল তাদের মধ্যে ইহুদিদের সপ্তাহের মর্যাদাপূর্ণ দিন ছিল শনিবার আর খ্রীস্টানদের জন্য রবিবার। অতঃপর মহান আল্লাহপাক এই উম্মতকে জুমুয়ার (শুক্রবার)  দিনটিকে মর্যাদা দিয়ে হাদায়েত করেছেন। এই তিনটি দিনের মধ্যে সবার আগে আসে শুক্রবার, এরপর শনিবার এবং সবশেষে রবিবার। এই ধারা অনুযায়ী হাশরের ময়দানে আল্লাহপাক তাঁর বান্দাদের পুনর্জ্জীবিত করবেন। উম্মতে মুহাম্মদি পৃথিবীতে সবার শেষে এসেছে, কিন্তু এই উম্মতকে সবার আগে পুনরুত্থান করা হবে, এবং সবার আগে হিসাব নিকাশ শুরু করা হবে। (দেখুন মুসলিম, ৮৫৬)

উপরের বক্তব্যের ব্যাখ্যায় আন নববী (রহঃ) বলেছেন যে, উপরের হাদিসের মানে হচ্ছে, পূর্বের উম্মতের জন্যও জুমুয়ার দিন মর্যাদাশীল ছিল এবং এই দিনে ইবাদত ওয়াযিব ছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে আল্লাহপাক স্পষ্ট করে কোন আদেশ দেন নি। বরং আল্লাহপাক তাদের উপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই উম্মত সেটা বুঝতে পারেনি এবং আল্লাহপাক ও তাদের সেই হেদায়াত করেন নি। কিন্তু উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য এটা ছেড়ে দেয়া হয়নি। বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে হেদায়েত স্বরুপ পরিষ্কার আদেশ এসেছে।

এরশাদ হয়েছে যে, মুসা (আঃ) তাঁর উম্মতকে জুমুয়ার দিনের ফযীলত এবং মর্যাদা সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন। কিন্তু তাঁর ক্বওম বনী ইসরাইল, এ ব্যাপারে মুসা (আঃ) এর সাথে তর্কে লিপ্ত হয়। অবশেষে, শনিবারকে তারা তাদের পবিত্র দিন হিসেবে নির্ধারণ করে নেয়। বনী ইসরাইলের উপর জুমুয়ার দিনের ব্যাপারে স্পষ্ট আদেশ না আসার পেছনেও মহান আল্লাহর প্রজ্ঞা রয়েছে। কারণ কোন ব্যাপারে আল্লাহ কোন আদেশ না দিলে সেটা ঐচ্ছিক হয়ে যায়। কিন্তু যদি আল্লাহর স্পষ্ট আদেশ থাকে তাহলে তা ফরয হয়ে যায়। আর বনী ইসরাইলকে আদেশ দেয়া হলেও তারা তা বাক বিতন্ডার মাধ্যমে অমান্য করা অসম্ভব ছিলনা। কারণ তারা সেই জাতি যারা বলেছিল,

"আমরা শুনলাম ও অমান্য করলাম।” (নিসাঃ৪৬)

আওস বিন আওস হতে বর্ণিত, রাসুল (সাঃ) বলেছেন,

"দিনের মধ্যে জুমুয়ার দিন হল শ্রেষ্ঠ। এই দিনে আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং এই দিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। এই দিনেই শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে এবং সমগ্র সৃষ্টিজগত মুর্চ্ছা যাবে। অতএব তোমরা আমার উপর বেশী বেশী দরুদ পাঠাও কেননা, তা আমাকে দেখানো হবে। তখন সাহাবারা আরজ করলেন, 'হে আল্লাহর রাসুল (সাঃ)! কিভাবে আমাদের দরুদ আপনাকে দেখানো হবে অথচ আপনি ওফাতের পর ধুলোয় পরিণত হয়ে যাবেন?' রাসুল (সাঃ) উত্তরে বললেন, আল্লাহপাক যমীনের জন্য নবীদের দেহ খেয়েফেলাকে হারাম করে দিয়েছেন।"  (আবু দাউদ, ১০৪৭)

হযরত আবু হুরায়রাহ্‌ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসুল (সাঃ) বলেন

"যে সমস্ত দিনে সূর্য উদিত হয় তাঁর মধ্যে শ্রেষ্ঠ হল জুমুয়ার দিন। এই দিনে আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে, এই দিনে তাঁকে জান্নাতে দাখিল করা হয় এবং এই দিনেই তিনি জান্নাত থেকে বহিষ্কৃত হন।" (মুসলিম, ১৪১০) 

আল ক্বাদি ইয়াদ (রহঃ) এই হাদিসের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, যে জুমুয়ার দিন শুধু ঐতাহাসিক ঘটনাপঞ্জীর কারনে মর্যাদা পায়নি, বরং ভবিষ্যতেও এই দিনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটবে।  

সমগ্র সৃষ্টিজগত জুমুয়ার দিনকে ভয় করে। কারণ এই দিনেই একটা বিশেষ সময়ে ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে। 
এছাড়া জুমুয়ার দিনে যেসমস্ত আমল করলে তা মর্যাদা বৃদ্ধিত কারণ হয়, তা নিচে আলোচনা করা হলঃ 

জুমুয়ার সালাতঃ  

জুমুয়ার সালাত হচ্ছে সপ্তাহের সকল সালাত এর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সালাত। মহান আল্লাহপাক কুরআনে ইরশাদ করেন

"মুমিনগণ, জুমআর দিনে যখন নামাযের আযান দেয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের পানে ত্বরা কর এবং বেচাকেনা বন্ধ কর। এটা তোমাদের জন্যে উত্তম যদি তোমরা বুঝ। (৬২:৯)

 মুসলিম শরীফে (২৩৩) এসেছে, হযরত আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসুল (সাঃ) বলেছেন যে, জুমুয়ার নামায কোন বান্দার জন্য সেই জুমুয়া হতে পরের জুমুয়া পর্যন্ত সকল গুনাহ মুছে দেয়, যতক্ষণ না সেই বান্দা কবীরা গুনাহ করে।

 ফজরের সালাত জা'মাতে আদায় করাঃ

ইবনে উমার হতে বর্ণিত রাসুল (সাঃ) বলেছেন,

"আল্লাহর কাছে সবচাইতে উত্তম সালাত হল, জুমুয়ার দিনের ফজর সালাত যা জা'মাতের সাথে আদায় করা হয়।" (সহীহ আল জাম', ১১১৯)

জুমুয়ার দিনের ফজরের সালাতের একটি বিশেষ সুন্নাহ আছে। তাহলো, প্রথম রাক'আতে সুরাহ আল-সাজদাহ এবং দ্বিতীয় রাকাতে সুরা আল ইনসান পাঠ করা। (বুখারী, ৮৫১; মুসলিম, ৮৮০)

আল হাফিয ইবনে হাযা'র (রহঃ) বলেছেন যে, জুমুয়ার ফজর নামাযে এই দুইটি সুরা পড়ার অন্যতম কারণ হল, এই সুরা গুলোতে হযরত আদম (আঃ) এর ঘটনা এবং ক্বিয়ামতের ঘটনা বর্ণিত আছে। অপরদিকে, এই দিনেই আদম (আঃ) কে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং এই দিনেই ক্বিয়ামত হবে।

জুমুয়ার দিনে মৃত্যু হলে তাঁর মর্যাদাঃ

যে মুসলিম ব্যক্তি জুমুয়ার রাতে বা দিনে মারা যায়, আল্লাহপাক তাঁকে কবরের ফিতনা থেকে হেফাযত করবেন। 

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর হতে বর্ণিত, রাসুল (সাঃ) বলেন

  "এমন কোন মুসলিম নেই যে জুমুয়ার রাত বা দিনে মৃত্যুবরণ করে অথচ তাঁকে কবরের ফিতনা থেকে হিফাযত করা হয়না।"   (তিরমীযি, ১০৭৪) 

জুমুয়ার খুতবা শোনাঃ 

জুমুয়ার খুতবা শোনা অনেক বড় সওয়াবের কাজ। জুমুয়ার দিনে মসজিদের প্রত্যেক দরজায় ফেরেস্তারা দাঁড়িয়ে থাকে এবং মুসল্লিদের নাম লিপিবব্ধ করতে থাকে, যতক্ষণ না জুমুয়ার খুতবা শুরু হয়। খুতবা শুরু হয়ে গেলে তাঁরা দপ্তর গুটিয়ে বসে পড়ে এবং খুতবা শোনে। ঐ দিন মসজিদে সে সবার আগে আসে সে একটি উট কোরবানীর সওয়াব পায়। এরপর যে আসে সে পায় গরু কুরবানীর সওয়াব। এরপরের জন পায় শিং ওয়ালা মেষ কুরবানীর সওয়াব, এরপরের জন পায় মুরগী কুরবানীর সওয়াব, এবং এরপরের জন পায় ডিম কুরবানীর সওয়াব। (বুখারী, ১৪১৬)

 সুরা কাহাফ পাঠ করাঃ

জুমুয়ার দিনের আরেকটি আমল হল, এর রাতে বা দিনে সুরা কাহাফ পাঠ করা। এ প্রসঙ্গে একাধিক সহীহ হাদিস রয়েছে।

আবু সাঈদ খুদরী হতে বর্ণিত

"জুমুয়ার রাতে যে সুরা কাহ্‌ফ পড়বে, তাঁর থেকে এমন এক নুর বের হবে যা তাঁর থেকে পবিত্র ক্বাবা পর্যন্ত বিস্তৃত হবে।” (আদ দারিমী, ৩৪০৭। শাইখ আল্বানী একে সহীহ বলেছেন।)

এছাড়া আল হাকীমে (২/৩৯৯) বর্ণিত হয়েছে যে

"যে জুমুয়ার দিনে সুরা কাহা্‌ফ পড়ে, তাঁর এমন একটা নুর সে লাভ করে যা পরবর্তী জুমুয়া পর্যন্ত চমকাতে থাকে।"

আলবানী একে সহীহ বলেছেন এবং এটাই সবচেয়ে শক্তিশালী রেওয়ায়েত।  

আবার, ইবনে উমার (রাঃ) বলেছেন, রাসুল (সাঃ) বলেছেন,

 "যে ব্যক্তি জুমুয়ার দিনে সুরা কাহ্‌ফ পড়ে, তাঁর পায়ের তলা থেকে আসমানের মেঘ পর্যন্ত একটা বিশাল নুর লাভ হয়। এই নুর ক্বিয়ামতের সময়ও তাঁর জন্য চমকাতে থাকবে। সেই জুমুয়া থেকে পরবর্তী জুমুয়ার মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।"   (আল তারগীব অয়াল তারহীব, ১/২৯৮) 

জুমুয়ার রাতে সুরা দুখান পড়ার যে হাদিস রয়েছে, তা অত্যন্ত দুর্বল। আলবানী এ কথা বলেছেন।  


ইতিক্বাফ ও দুয়া করাঃ  

জুমুয়ার দিনে আসর হতে মাগরীব পর্যন্ত সময়ে এমন একটা মুহুর্ত আছে যে সময় অবশ্যই আল্লাহতাআলা তাঁর বান্দার দুয়া কবুল করেন। তাই এই সময় ইতেকাফ করে আল্লাহর দরবারে দুয়া করা অনেক ভাল একটি আমল। 
                                                             (www.Islamqa.com ওয়েবসাইট হতে সংকলিত)


অন্যদের সাথে শেয়ার করুন

No comments:

Powered by Blogger.