বিনয় এবং ইসলাম



মানুষ সামাজিক জীব সমাজ ছাড়া মানুষ অচল সমাজে চলার তাগিদেই মানুষকে বিভিন্ন লেনদেন এবং পারস্পরিক আদান-প্রদান করতে হয় এবং এই আদান-প্রদান বা লেনদেনের ক্ষেত্রেই মানবিক চরিত্রের বহির্প্রকাশ ঘটে মানব চরিত্রের দুটি দিক রয়েছে ভালো মন্দ মানুষের যে স্বভাবটি প্রাধান্য পায়, ঠিক সে দিকেই খ্যাতি লাভ করে মানুষ কেউ হয় ভালো মানুষ আর কেউ হয়ে যায় মন্দ যাদের চরিত্রে উত্তম গুণাবলির সমাবেশ ঘটে, সে হয় স্মরণীয় বরণীয় আর যার চরিত্র মন্দ দোষে দুষ্ট হয়, সে হয় মন্দ পরিত্যাজ্য ইসলাম মানুষকে যেসব ভালো গুণকে আয়ত্ত করার নির্দেশ বা উৎসাহ প্রদান করেছে, বিনয়ী হওয়া বা নম্রতা অবলম্বন করা তার অন্যতম একজন মুসলিম সবার সঙ্গে সবক্ষেত্রে বিনয়ী আচরণ করবে, নম্রতা হবে তার মুসলিম চরিত্রের অন্যতম দিক এমনটাই ইসলামের নবি হজরত মুহাম্মদের [সা.] শিক্ষা
বিনয় ইসলামের পরিচয়
বিনয়ের আসল অর্থ হচ্ছে সত্যকে দ্বিধাহীনচিত্তে মেনে নেয়া, হোক তা যে কারও কাছ থেকে এর আরেকটি অর্থ নিজেকে অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে না করা
প্রখ্যাত মনীষী হাসান বসরী বলেছেন, নিজের ঘর থেকে বের হওয়ার পর যে কারও সঙ্গে সাক্ষাত্ হবে তাকে নিজের চেয়ে ভালো মনে করার নামই বিনয় হজরত ঈসা আলাইহিস সালাম বলতেন, পৃথিবীতে যারা বিনয়ী থাকবে, কিয়ামতের মাঠে তাদের জন্য কি আনন্দ! তারা সেদিন আসনে বসে থাকবে যারা আজ মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলিয়ে তাদের মিলিয়ে দেয়, তারাই তো সর্বোচ্চ জান্নাত ফিরদাউসের প্রকৃত অধিকারী পৃথিবীতে আমরা কি নিয়ে বড়াই করি? সামান্য বিত্তবৈভবে আমরা অন্যকে তুচ্ছ করি আমরা ভুলে থাকি, আমাদের ওপর রয়েছেন এক মহান শক্তিমান শ্রষ্টা তিনি সবকিছু দেখছেন এবং হিসাবের খাতায় এসব লিখে রাখা হচ্ছে পরম শক্তিমান আল্লাহপাকের বড়ত্ব এবং তার শ্রেষ্ঠত্ব যার হৃদয়ে থাকে, সেজন সবসময় নিজেকে লুকিয়ে রাখতে ভালোবাসে মানুষের সঙ্গে তার আচরণ বিনয় নম্রতায় মিশে থাকে মুসলিম শরিফে ইয়ায [রা.] বর্ণনা করেছেন, একদিন রাসুল আমাদের বললেন, আল্লাহপাক আমার কাছে নির্দেশনা পাঠিয়েছেন, যাতে তোমরা বিনয়ী হও একে অন্যের ওপর গর্ব করবে না এবং রাগও হবে না
মুসনাদে আহমদের এক হাদিসে রাসুল [সা.] বলেছেন, আল্লাহপাকের জন্য যে যত বেশি নিচু হবে (এই বলে রাসুল নিজের হাতকে মাটির দিকে নামিয়ে দেখালেন), নিজেকে বিনয়ী করে রাখবে, আল্লাহপাক তাকে তত বেশি উঁচু করবেন (রাসুল তার হাতের তালু উপরের দিকে উঠিয়ে দেখালেন) অর্থাত্ মানুষের কছে সম্মানিত করবেন মুসলিম শরিফের আরেকটি হাদিসে রাসুল [সা.] বলেছেন, দান-সদকায় কখনও সম্পদ কমে না, ক্ষমা করুণায় আল্লাহপাক ওই লোকটির সম্মান বাড়িয়ে দেন এবং যে আল্লাহর জন্য বিনয় দেখাল, তাকে তিনি অনেক উঁচুতে অবস্থান করে দেন
বিনয় নম্রতা উত্তম চরিত্রের ভূষণ
মানুষের জীবনে যত উত্তম গুণাবলী রয়েছে তার মধ্যে উত্তম গুণ হলো- বিনয় নম্রতা বিনয় নম্রতা উত্তম চরিত্রের ভূষণ যার মূর্ত প্রতীক হচ্ছেন আমাদের প্রিয় নবি হজরত মুহাম্মদ [সা.] তার সাহাবিরা বিনয় নম্রতা দ্বারাই তারা মানুষকে আপন করে নিয়েছেন বিনয়ী ব্যক্তিকে আল্লাহ যেমন ভালোবাসেন, তেমনি মানুষও তাকে ভালোবাসেন যে আল্লাহর উদ্দেশ্যে বিনয়ী হয়, আল্লাহ তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন বিনয় নম্রতা সম্পর্কে মহান আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, যারা তোমার অনুসরণ করে সেসব বিশ্বাসীর প্রতি বিনয়ী হও [সূরা আশ্-শুআরা : ২১৫]
অন্য আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, মুহাম্মদ [সা.] আল্লাহর রাসূল এবং তার সঙ্গে যারা আছে, তারা কাফিরদের প্রতি বজ্র কঠোর আর নিজেরা নিজেদের প্রতি বড়ই করুণাশীল [সূরা আল ফাতহ : ২৯] আল্লাহ তায়ালা সূরা আল মায়েদার ৫৪ নং আয়াতে ইরশাদ করেছেন, হে ইমানদারগণ! তোমাদের মধ্যে কেউ যদি নিজের দীন থেকে ফিরে যায়, আল্লাহ আরও অনেক লোক তৈরি করবেন; যারা হবে আল্লাহর প্রিয় এবং আল্লাহ হবেন তাদের প্রিয় যারা মুমিনদের প্রতি নম্র বিনয়ী হবে এবং কাফেরদের প্রতি হবে অত্যন্ত কঠোর মহান আল্লাহতায়ালা আরও ইরশাদ করেন, তারাই তো আল্লাহর প্রকৃত বান্দা যারা যমিনে নম্রতার সঙ্গে চলাফেরা করে আর যখন মূর্খ লোকরা তাদের সঙ্গে আল্লাহর বিষয়ে তর্ক করে তখন তারা বলে দেয় তোমাদের সালাম [সূরা আল-ফুরকান : ৬৩]
বিনয় নম্রতা সম্পর্কে হাদিস শরিফে উল্লেখ রয়েছে, হজরত আয়েশা [রা.] থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ [সা.] বলেছেন, আল্লাহ স্বয়ং নম্র, তাই তিনি নম্রতাকে ভালোবাসেন তিনি কঠোরতার জন্য যা দান করেন না; তা নম্রতার জন্য দান করেন নম্রতা ছাড়া অন্য কিছুতেই তা দান করেন না (মুসলিম) অন্য হাদিসে আরও বলা, হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা [রা.] থেকে বর্ণিত নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ [সা.] বলেছেন, দানের সম্পদ কমে না ক্ষমার দ্বারা আল্লাহ তার বান্দার ইজ্জত সম্মান বৃদ্ধি করা ছাড়া আর কিছুই করেন না আর সে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে বিনয় নম্রতা নীতি অবলম্বন করে, আল্লাহ তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন [মুসলিম]
পৃথিবীতে দম্ভভরে পদচারণা কর না
মানবতার শ্রেষ্ঠ রাসুল [সা.] বলেছেন, আল্লাহ মহান অহির মাধ্যমে আমার কাছে নির্দেশ পাঠিয়েছেন, নম্রতা হেয়তা অবলম্বন কর অর্থাৎ বিনয়ী হও কেউ যেন অন্যের ওপর গর্ব অহংকারের পথ অবলম্বন না করে এবং কেউ যেন কারো ওপর অত্যাচার না করে (মুসলিম) আমাদের নবিজির ৬৩ বছরের সুদীর্ঘ জীবনের গোটাটাই নম্রতা আর বিনয়ী আচরণে পরিপূর্ণ কেবল ইসলামপ্রিয় মানুষদের সঙ্গেই নয়, তৎকালীন কাফির-মুশরিকরাও নবিজির ব্যাপারে বিনয়ী না হওয়া বা নম্র স্বভাবের অধিকারী না হওয়ার কোনো অভিযোগ করতে পারেনি বিনয়ী, নম্র এবং কোমল আচরণের অধিকারী মানুষকে সবাই পছন্দ করে কেবল ইসলাম ধর্মেই নয়, সব ধর্মে এবং সামাজিক বিবেচনায়ও বিনয়ী মানুষের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে নম্রতা মানুষকে সামাজিকভাবে সম্মানিত করে

পবিত্র কোরানে আল্লাহ মহান ইরশাদ করেছেন, পৃথিবীতে দম্ভভরে পদচারণা কর না নিশ্চয় তুমি ভূপৃষ্ঠকে কখনই বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত সমান হতে পারবে না এসবের মধ্যে যেগুলো মন্দ কাজ সেগুলো তোমার পালনকর্তার কাছে অপছন্দনীয় (বনি ইসরাইল-৩৮,৩৯) নম্রতা এবং স্বভাবের বিনয়ী ভাব একজন মুসলমানের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, এমনকি সামাজিক জীবন পর্যন্ত ব্যাপ্ত আল্লাহ আমাদের সবাইকে বিনয়ী এবং নম্র স্বভাবের অধিকারী হওয়ার তওফিক দান করুন আমিন
লা হাওলা ওয়ালা ক্যুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ্‌।
পোস্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না। আপনার শেয়ারে যারা যারা উপকৃত হবেন, তাদের সওয়াব আপনিও পাবেন। 

No comments:

Powered by Blogger.