দু’আ
আভিধানিক অর্থে দুআ: দুআ শব্দের অর্থ
আহ্বান, প্রার্থনা। শরীয়তের
পরিভাষায় দুআ বলে কল্যাণ
ও উপকার লাভের উদ্দেশ্যে
এবং ক্ষতি ও অপকার
রোধকল্পে মহান আল্লাহকে ডাকা
এবং তার নিকট সাহায্য
প্রার্থনা করা। দুআ
শব্দ পবিত্র কুরআনে বিভিন্ন
অর্থে ব্যবহার হয়েছে:
- ইবাদত: মহান আল্লাহ বলেন, “তোমাদের পালনকর্তা বলেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি সাড়া দিব, যারা আমার ইবাদতে অহংকার করে তারা অচিরে জাহান্নামে প্রবেশ করবে লাঞ্চিত হয়ে।” (আল-মুমিন-৬০)
- সাহায্য প্রার্থনা: আল্লাহ বলেন, “যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক, আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের সব সাহায্যকারীদেরকে আহবান কর।” (আল-বাকারা-২৩)
আল্লাহর
মুখাপেক্ষী হওয়া এবং তার
নৈকট্য লাভ করা ব্যতীত
মানুষের কোন উপায় নেই,
আর দুআ হল আল্লাহর
নৈকট্যলাভের বিশেষ বাহন ও
মাধ্যম। আল্লাহর
নিকট প্রার্থনা, প্রত্যাশা ও সাহায্য কামনার
মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর নিকটবর্তী
হয়। এ
দ্বারা মানুষ তার প্রতিপালকের
ইবাদত করে, উদ্দেশ্যে উপনীত
হয়, তার সন্তুষ্টি লাভ
করে।
দুআর
ফযিলত ও উপকারিতা: দুআতে রয়েছে প্রভূত
ফযীলত, মহা পুরস্কার, শুভ
পরিণতি ও অনেক উপকার। নিম্নে
তারই কিছু উল্লেখ করা
হল:
- দুআ ইবাদত, দুআকারী ব্যক্তি দুআর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে এবং পুরুস্কার প্রাপ্ত হয়: আল্লাহ বলেন: “তাদের পার্শ্ব শয্যা হতে আলাদা থাকে। তারা তাদের পালনকর্তাকে ডাকে ভয়ে ও আশায় এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় কর। কেউ জানে না তার জন্য কৃতকর্মের কি কি নয়ন প্রীতিকর প্রতিদান লুকায়িত আছে।” (সাজদা : ১৬-১৭)
- দুআতে রয়েছে দুআকারী ব্যক্তির আবেদনের সাড়া: মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের পালনকর্তা বলেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি সাড়া দিব’। (আল-মুমিন:৬০) মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘আর আমার বান্দারা যখন তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে বস্তুত: আমি রয়েছি সন্নিকটে’। (সূরা আল বাকারা ১৮৬)
- দুআতে রয়েছে স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য ও হীনতা-দীনতার প্রকাশ: মহান আল্লাহ বলেন, “তোমরা স্বীয় প্রতিপালককে ডাক কাকুতি মিনতি করে এবং সংগোপনে। তিনি সীমা অতিক্রমকারীদের পছন্দ করেন না। পৃথিবীকে কুসংস্কারমুক্ত ও ঠিক করার পর তাতে ফাসাদ সৃষ্টি করো না। তাকে আহবান কর ভয় ও আশা সহকারে। নিশ্চয় আল্লাহর করুণা সৎকর্মশীলদের নিকটবর্তী।” (আরাফ :৫৫,৫৬)
- দুআ ইহকাল ও পরকালে দুআকারী ব্যক্তি থেকে অনিষ্ট রোধ করে ও পাপ মোচন করে।
দুআ
কবুলের শর্তাবলী: মুমিনের প্রত্যাশা মহান আল্লাহ যেন
তার দুআ কবুল করেন
এবং তার মনের আশা
পূরণ করেন। কিন্তু
দুআ কবুল হওয়ার জন্য
কিছু শর্ত আছে।
নিম্নে তা উল্লেখ করা
হল:
- ইখলাছ: এটি আমল কবুল হওয়ার মূল শর্ত। মহান আল্লাহ বলেন, “তিনি চিরঞ্জিব, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। অতএব, তাকে ডাক খাটি ইবাদতের মাধ্যমে।” (আল-মুমিন:৬৬) সব কিছু বাদ দিয়ে কেবল আল্লাহর জন্য ইবাদতকে নিরঙ্কুশ করার নাম ইখলাস। সুতরাং, ইবাদত ও দুআ মহান আল্লাহ ব্যতীত কোন কিছুকে উদ্দেশ্যে করা যাবে না। এর বিপরীত কর্মপন্থা যে অবলম্বন করল, সে অবশ্যই শিরক করল। মহান আল্লাহ বলেন, “যে আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্যকে ডাকে, যার স্বপক্ষে কোন দলীল তার কাছে নেই, তার হিসাব তার পালনকর্তার কাছে আছে। নিশ্চয় কাফেররা সফলকাম হবে না।” (সূরা আল মুমিন ১১৭)
- দুআকারী ব্যক্তির সম্পদ হালাল হওয়া: কেননা, হারাম সম্পদ হচ্ছে দুআ কবুলের পথে অন্তরায় ও বাধা। ইমাম মুসলিম রহ. তার সহীহ গ্রন্থে আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন: “হে মানুষ সকল! নিশ্চয় আল্লাহ পুত:পবিত্র, তিনি পবিত্র জিনিস ব্যতীত কবুল করেন না। নিশ্চয় আল্লাহ রাসূলদের যে আদেশ দিয়েছেন তা মুমিনদের জন্যও আদেশরূপে বিবেচ্য। আল্লাহ বলেন, ‘হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু হতে আহার কর এবং সৎকাজ কর; তোমরা যা কর সে সম্বন্ধে আমি সবিশেষ অবহিত’। (আল- মুমিনূন-৫১) এবং আল্লাহ আরো বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা পাক পবিত্র বস্তু সামগ্রী আহার হিসেবে ব্যবহার কর, যেগুলো আমি তোমাদেরকে রুযী হিসেবে দান করেছি’। (আল-বাকারা- ১৭৩) অতঃপর উস্কখুস্ক ধূলোময় অবস্থায় দীর্ঘ সফরকারী একজন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করে বলেন, যে স্বীয় হস্তদ্বয় আকাশের দিকে প্রসারিত করে বলে, হে প্রভু! হে প্রভু! অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পোশাক হারাম এবং সে হারাম দ্বারা লালিত, তার দুআ কিভাবে কবুল হবে? (মুসলিম -১৬৮৬)
- দুআয় সীমালঙ্ঘন না করা: দুআর সময় বান্দা বৈধ সীমারেখায় বিচরণ করবে, পাপের কাজ সিদ্ধ করা বা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা, অথবা সামান্য ভুলের শাস্তি স্বরূপ কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠির ধ্বংসের জন্য দুআ করবে না। মহান আল্লাহ বলেন, “তোমরা স্বীয় প্রতিপালককে ডাক, কাকুতি মিনতি করে এবং সংগোপনে। তিনি সীমা অতিক্রমকারীদের পছন্দ করেন না।” (আরাফ:৫৫)
দুআ
কবুলের অন্তরায় সমূহ: উপরের আলোচনায় আমরা
দুআ কবুলের শর্ত সম্পর্কে
জানতে পেরেছি, নীচে দুআ কবুলের
অন্তরায় সমূহ সংক্ষেপে উল্লেখ
করা হলঃ
- দুআতে এখলাস না থাকা।
- আল্লাহর সাথে শিরক করা।
- অবৈধ কারবার করা, ভেজাল দেয়া।
- সুদ খাওয়া।
- অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ ভক্ষণ করা।
- ঘুষ নেওয়া।
- দুআতে সীমালঙ্ঘন করা।
- অবৈধ বা বিদ্য়ী দুআ করা যথা-মৃত বা কবরস্থ ব্যক্তির অসীলা গ্রহণ করে দুআ করা।
উল্লেখিত
প্রত্যেকটি বিষয় স্বতন্ত্র ভাবে
দুআ কবুলের অন্তরায়।
অতএব প্রত্যেক মুসলমানের উপর অবশ্য কর্তব্য
হল, সে যেন দুআ
কবুলের যে কোন অন্তরায়
থেকে নিজেকে দূরে রাখে।
দুআর
আদব সমূহ:
- বিনয়-বিনম্রতা ও একাতগ্রতা সাথে দুআ করা।
- সংকল্প ও আকুতির সাথে দুআ করা, দুআ কবুলে প্রবল আশাবাদী হওয়া। আনাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: “যখন তোমরা দুআ করবে, তখন প্রার্থিত বিষয়টি লাভের ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস রাখবে, এবং বলবে না- হে আল্লাহ! যদি তুমি চাও আমাকে প্রদান কর, কেননা, আল্লাহকে বাধ্যকারী কেউ নাই।” বুখারী-৫৮৬৩
- দুআকারী যেন উত্তম সময় ও স্থান বেছে নেয়। যেমন: আরাফা দিবস, রমযান মাস, জুমার দিন, কদরের রাত, প্রত্যেক রাতের শেষাংশ, সালাতে সাজদারত অবস্থা, আযান ইকামতের মাধ্যবর্তী সময়, সফরকালীন সময়, সিয়ামের সময় অসহায়ত্বের সময়, হজ্বের সময়, বিশেষভাবে তাওয়াফ সায়ীর সময় এবং জামরাতে পাথর নিক্ষেপের পর। এছাড়া, বিশেষ বিশেষ সময় ও স্থান সমুহে।
- পবিত্র অবস্থায় কেবলামূখী হয়ে হাত তুলে দুআ করা। দুআর শুরু এবং শেষে আল্লাহর প্রশংসা করা এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর সালাত ও সালাম পেশ করা।
বৈধ
দুআর কতিপয় উদাহরণ:
- ইহকাল ও পরকালের কল্যাণের জন্য দুআ করা।
- সন্তান সঠিক ও সৎ পথে চলার জন্য দুআ করা।
- অসুস্থ ব্যক্তির শেফা ও পুরুস্কার প্রাপ্তির দুআ করা।
- উপকারকারী ব্যক্তির জন্য দুআ করা।
- মুজাহিদ ও সাধারণ মুসলমানের জন্য ইহকাল ও পরকালের কল্যাণের দুআ করা।
আপনার পরিবার, পরিজন, সন্তান ও অন্যদের কেও এই দাওয়াহ্ পৌঁছে দিন।
No comments: